BN/Prabhupada 0649 - মন হচ্ছে চালক আর এই দেহটি হচ্ছে রথ বা গাড়ি



Lecture on BG 6.2-5 -- Los Angeles, February 14, 1969

ভক্তঃ শ্লোক সংখ্যা ৫। "মানুষের কর্তব্য তার মনের দ্বারা নিজেকে জড় জগতের বন্ধন থেকে উদ্ধার করা। মনের দ্বারা আত্মাকে অধঃপতিত করা উচিৎ নয়। মনই জীবের অবস্থাভেদে বন্ধু ও শত্রু হয়ে থাকে।" (ভগবদগীতা ৬.৫)

তাৎপর্যঃ অবস্থানুসারে, আত্মা বলতে দেহ, মন ও আত্মাকে বোঝায়। যোগপন্থায় বদ্ধ জীবাত্মা ও মনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। যেহেতু মনই হচ্ছে যোগাভ্যাসের কেন্দ্র তাই এখানে আত্মা বলতে মনকে বোঝানো হয়েছে। যোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে মনকে বশ করে ইন্দ্রিয় বিষয়ের আসক্তি থেকে সম্পূর্ণ অনাসক্ত রাখা। এখানে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, মনকে এমনভাবে সংযত করতে হবে যাতে সে বদ্ধজীবকে অজ্ঞান সাগর থেকে উদ্ধার করতে সমর্থ হয়।"

শ্রীল প্রভুপাদঃ অষ্টাঙ্গ যোগের পন্থায়, ধ্যান এবং ধারণার উদ্দেশ্য হচ্ছে মনকে নিয়ন্ত্রণ করা। যদি তুমি মনকে সংযত না কর... শুরুতেই বলা হয়েছে যে মানুষের কর্তব্য মনের দ্বারা নিজেকে উদ্ধার করা। মন হচ্ছে সারথি বা চালক। এই দেহটি হচ্ছে রথ বা গাড়ি। ঠিক যেমন যদি তুমি তোমার গাড়ি-চালককে নির্দেশ দাও, "আমাকে কৃষ্ণভাবনাময় মন্দিরে নিয়ে চল"। চালক তোমাকে এখানে নিয়ে আসবে। আর যদি তুমি তোমার চালককে বল "আমাকে ঐ মদের দোকানে নিয়ে চল।" তাহলে সে তোমাকে ওখানেই নিয়ে যাবে। চালকের কাজ হচ্ছে তুমি যেখানে চাও সেখানেই তোমাকে নিয়ে যাওয়া। ঠিক তেমনই তোমার মনটি হচ্ছে তোমার চালক। যদি কেবল তুমি নিয়ন্ত্রণ করতে পার... কিন্তু যদি সেই চালক তোমার থেকে এই অনুমোদন পেয়ে যায় যে, সে যেখানে চায় সেখানেই তোমাকে নিয়ে যাবে, তাহলেই তোমার সর্বনাশ। সেই ক্ষেত্রে তোমার চালক হচ্ছে তোমার শত্রু। কিন্তু যদি তোমার চালক তোমার কথামতো চলে, তাহলে সে তোমার বন্ধু। তাই প্রকৃতপক্ষে যোগপন্থার মানেই হচ্ছে মনকে এমনভাবে সংযত করা আতে সে তোমার বন্ধুর মতো কাজ করে, শত্রুর মতো নয়।

আসলে মন আমার কথামতো চলছে, কারণ আমার ক্ষুদ্র স্বাধীনতা রয়েছে, যেহেতু আমি সেই পরমেশ্বর ভগবানের অংশবিশেষ যিনি পূর্ণরূপে স্বাধীন, তাই আমারও ক্ষুদ্র স্বাধীনতা রয়েছে। মন সেই স্বাধীনতাটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যদি মন বলে, ঠিক আছে, চল, কৃষ্ণভাবনাময় মন্দিরে যাওয়া যাক।" আর মন আবার এও বলতে পারে, "ওহ, কৃষ্ণ! কি সব আজেবাজে জিনিস। কোনও ক্লাবে যাওয়া যাক।" সুতরাং মন তোমাকে পরিচালনা করছে। তাই আমাদের কৃষ্ণভাবনাময় আন্দোলনটি হচ্ছে মনকে শ্রীকৃষ্ণে নিবদ্ধ করা, ব্যাস। তাকে অবশ্যই বন্ধুর মতো কাজ করতে হবে। আর অন্য কাউকে জায়গা দেয়ার মতো সুযোগ তার নেই। ঠিক যেই মুহূর্তে শ্রীকৃষ্ণ এই মনে আসন গ্রহণ করবেন, ঠিক যেমন যেই মুহূর্তে সূর্যালোক প্রবেশ করে, সূর্য আকাশে উদিত হন, অন্ধকারের আর কোন সুযোগই থাকে না। কোনও সম্ভাবনাই থাকে না। আঁধার কখনও সূর্যের কাছে আসবে না। ঠিক তেমনই শ্রীকৃষ্ণ হলেন সূর্যের মতো। তুমি শ্রীকৃষ্ণকে তোমার মনে স্থাপন কর। মায়া অন্ধকার কখনই তোমার কাছে আসতে পারবে না। সেটিই হচ্ছে সর্বোত্তম যোগপন্থা। তাকেই বলা হয় যোগসিদ্ধি। যখন কারও মন এতোটাই দৃঢ় হয় যে সে কোনও আজেবাজে কিছু প্রবেশ করতে দেয় না, তাহলে আর অধঃপতনের সম্ভাবনা কোথায়? মন বা চালক এতোই শক্তিশালী তোমার ইচ্ছে ছাড়া সে তোমাকে কোথাও নিয়ে যেতে পারবে না।

তাই এই সম্পূর্ণ যোগপন্থাটি হচ্ছে মনকে শক্তিশালী করার জন্য। ভগবান থেকে যাতে বিচ্যুত না হয়ে যায়। সেটিই হচ্ছে যোগপদ্ধতির সাফল্য। স বৈ মনঃ কৃষ্ণ পদারবিন্দয়োঃ (শ্রীমদ্ভাগবত ৯.৪.১৮) মানুষের উচিৎ তার মনকে অম্বরীষ মহারাজের ন্যায় শ্রীকৃষ্ণে নিবদ্ধ করা। অষ্টাঙ্গ যোগী দুর্বাসা মুনির সঙ্গে তাঁর এক বিশাল যুদ্ধ হয়েছিল। মহারাজ অম্বরীষ ছিলেন একজন রাজা, গৃহস্থ, তিনি বিশাল ধনসম্পদের অধিকারী ছিলেন। গৃহী মানে হচ্ছে তাকে টাকা, পয়সা ইত্যাদির হিসেব রাখতে হবে। ডলার, পয়সা... তিনি সম্রাট ছিলেন। দুর্বাসা মুনি ছিলেন একজন মহান যোগী। তিনি সম্রাটের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ ছিলেন। আমি এক মহান যোগী আমি মহাশুন্যে বিচরণ করতে পারি, তাহলে এটি কিভাবে সম্ভব যে, এই এক সাধারণ রাজা, তিনি আমার মতো এইসব যৌগিক ভেল্কি দেখাতে পারেন না, কিন্তু তবুও লোকেরা তাকে সবচেয়ে বেশি সম্মান করে। কেন? আমি তাকে উচিৎ শিক্ষা দেব।" তাই তিনি সেই রাজার সঙ্গে কলহে লিপ্ত হলেন। সে এক বিশাল কাহিনী। আমি অন্য কোনও দিন সেই কাহিনী বলব। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সে পরাজিত হয়েছিল। এবং ভগবান নারায়ণ তাকে অম্বরীষ মহারাজের শ্রীচরণে শরণাপন্ন হতে নির্দেশ করেন। প্রামাণিক শাস্ত্র থেকে আমরা এই দৃষ্টান্তটি দেখতে পাই যে, তিনি কেবলমাত্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর হৃদয়ে রেখেছিলেন এবং এইভাবে সেই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগীকেও পর্যন্ত তিনি পরাস্ত করেছিলেন। দুর্বাসা মুনি এমনই সিদ্ধ যোগী ছিলেন যে এক বছরের মধ্যে সমস্ত জড় আকাশে তিনি ভ্রমণ করেছিলেন এবং জড় আকাশ ভেদ করে চিন্ময় আকাশে তিনি সরাসরি ভগবানের রাজ্য বৈকুণ্ঠ পর্যন্ত গিয়ে পরমেশ্বর ভগবানের দর্শন লাভ করেন। তা সত্ত্বেও তিনি এতোটাই শক্তিহীন ছিলেন যে তাকে ফিরে এসে অম্বরীষ মহারাজের শ্রীচরণে পতিত হতে হয়েছিল। কিন্তু মহারাজ অম্বরীষ ছিলেন একজন সাধারণ রাজা, তিনি কেবল মাত্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করছিলেন। ব্যাস। এইরকম দৃষ্টান্ত আমরা আরও দেখব। অতএব সর্বোচ্চ যোগসিদ্ধিপন্থা হচ্ছে মনকে সংযত করা। এবং তুমি যদি কেবল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণযুগল তোমার হৃদয়ে ধারণ করতে পার, তবে খুব সহজেই তুমি তোমার মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। কেবলমাত্র শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ কর, তাহলেই তুমি বিজয়ী হবে। তুমি সর্বোচ্চ যোগী হতে পারবে। কারণ, অবশেষে যোগ পন্থাটি হচ্ছে, 'যোগ ইন্দ্রিয়-সংযম'। যোগ মানে হচ্ছে ইন্দ্রিয় সংযম করা। আর ইন্দ্রিয়ের ওপরে রয়েছে মন। তাই যদি তুমি মনকে সংযৎ করতে পার, তাহলে ইন্দ্রিয়সমূহ আপনা থেকেই সংযত হয়ে যাবে। তোমার জিহ্বা বাজে কিছু খেতে চাইছে, কিন্তু তোমার মন অত্যন্ত শক্তিশালী। মন বলবে, "না, তুমি এটা খেতে পারবে না। কৃষ্ণপ্রসাদ ছাড়া তুমি কিছুই খেতে পারবে না।" তাহলেই জিহ্বা সংযত হবে। তাই ইন্দ্রিয়গুলো মনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরম্ মনঃ (গীতা ৩.৪২) আমার দেহ মানে ইন্দ্রিয়গুলো, অর্থাৎ আমার কার্যকলাপ মানেই হল ইন্দ্রিয়সুখের কার্যকলাপ। কিন্তু ইন্দ্রিয়গুলো থেকে মন শ্রেয়, মন থেকে বুদ্ধি শ্রেয়। আর আত্মা বুদ্ধির থেকেও শ্রেয়। যদি কেউ চিন্ময় স্তরে বিরাজ করেন, আত্মার স্তরে, তাহলে তাঁর বুদ্ধিও চিন্ময়, তাঁর মনও চিন্ময়, তাঁর ইন্দ্রিয়সমূহ চিন্ময় এবং তিনি নিজেও চিন্ময়। এই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃতের পন্থা। কারণ যদিও চিন্ময় আত্মা সক্রিয়, কিন্তু যেহেতু তিনি তাঁর ক্ষমতা এই মূর্খ মনের কাছে দিয়েছেন, তাই তিনি সুপ্তাবস্থায় রয়েছেন। যখন তিনি জাগ্রত; যখন প্রভু জাগ্রত থাকেন তখন ভৃত্য কোনও আজেবাজে কাজ করতে পারে না। তেমনই, যদি তুমি কৃষ্ণভাবনামৃতে জাগরিত হও, তাহলে তোমার বুদ্ধি , মন এবং ইন্দ্রিয়গুলো আর আজেবাজেভাবে কাজ করতে পারবে না। তারা নিশ্চয়ই সেই মোতাবেক কাজ করবে। সেটিই হচ্ছে চিন্ময়ীকরণ। তাকে বলা শুদ্ধিকরণ।

হৃষীকেন হৃষীকেশ সেবনং ভক্তিরুচ্যতে। (চৈতন্য চরিতামৃত মধ্য-১৯.১৭০) ভক্তি মানে অপ্রাকৃত স্তরে কর্ম করা। তুমি কিভাবে কর্ম করবে? তোমাকে ইন্দ্রিয়সমূহের দ্বারা কর্ম করতে হবে। অতএব তোমার এই ইন্দ্রিয়গুলোকে অপ্রাকৃত করতে হবে। ধ্যান, কার্যকলাপ বন্ধ করা মানে আজেবাজে কিছু করাকে বন্ধ করা। কিন্তু কৃষ্ণভাবনামৃতে কর্ম করা মানে তা সম্পূর্ণ চিন্ময়। ঠিক যেমন আজেবাজে কিছু করা থেকে তোমার ইন্দ্রিয়গুলোকে বন্ধ করতে হবে, কিন্তু সেটিই সাফল্য নয়। তোমাকে ভালোভাবে কর্ম করতে হবে। তবেই তা সার্থক। অন্যথায় যদি তুমি তোমার মনকে সঠিকভাবে কর্ম করতে না শেখাও, তাহলে তা আবারও অধঃপতিত হয়ে বাজে কাজ করবে। তাই আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে শ্রীকৃষ্ণের জন্য কর্ম করতে নিযুক্ত করা উচিৎ। তাহলে আর অধঃপতনের কোন সম্ভাবনা থাকবে না। সেটিই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃত।