BN/Prabhupada 0641 - ভক্তের কোনও চাহিদা নেই



Lecture on BG 6.1 -- Los Angeles, February 13, 1969

ভক্তঃ ষষ্ঠ অধ্যায়, সাংখ্য যোগ, প্রথম শ্লোক "পরমেশ্বর ভগবান বললেন, 'যিনি তাঁর কর্তব্যকর্ম এবং কর্মের ফলের প্রতি আসক্ত নন, তিনিই সন্ন্যাসী এবং প্রকৃত যোগী। যিনি অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞকর্ম করেন তিনি সন্ন্যাসী বা যোগী নন। (গীতা ৬.১) তাৎপর্যঃ এই অধ্যায়ে ভগবান বর্ণনা করেছেন যে অষ্টাঙ্গযোগ হচ্ছে মন এবং ইন্দ্রিয়গুলোকে সংযত করার পন্থাবিশেষ। তবে এই যোগ সকলের পক্ষে অনুশীলন করা কষ্টকর, বিশেষ করে এই কলিযুগে। এই অধ্যায়ে যদিও অষ্টাঙ্গ-যোগের পন্থার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু ভগবান দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করেছেন যে কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম বা কর্মযোগ অষ্টাঙ্গযোগ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এই জগতের সকলেই তার স্ত্রী, পুত্র, পরিজনের ভরণপোষণের জন্য কর্ম করে, কিন্তু ব্যক্তিগত স্বার্থ বা নিজের ভোগবাঞ্ছা ছাড়া কেউই কোন কর্ম করে না, হোক তা সে সংকুচিত স্বার্থ বা প্রসারিত স্বার্থ। কিন্তু সাফল্যের মানদণ্ড হচ্ছে কর্মফলের প্রত্যাশা না করে ভগবানের সন্তুষ্টির জন্য কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে কর্ম করা। প্রতি জীবেরই কর্তব্য হচ্ছে কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে কর্ম করা, কেননা প্রতিটি জীবই হচ্ছে ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। শরীরের বিবিধ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পূর্ণ শরীরের পালনপোষণের জন্য কর্ম করে। দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো নিজেদের সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে না বরং সম্পূর্ণ দেহের স্বার্থে কর্ম করে। তেমনই,, যে মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থের পরিবর্তে পরমেশ্বর ভগবানের তৃপ্তির জন্য কর্ম করেন, তিনি হচ্ছেন প্রকৃত সন্ন্যাসী, প্রকৃত যোগী।

"কিছু সন্ন্যাসীরা ভ্রান্তিবশত মনে করে যে, তারা সব্রকম জাগতিক কর্তব্য থেকে মুক্ত হয়েছে, এবং তাই তারা অগ্নিহোত্র যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান ত্যাগ করে।"

শ্রীল প্রভুপাদঃ প্রত্যেকেরই উচিৎ পবিত্রীকরণের জন্য কিছু যজ্ঞ অনুষ্ঠান করা। সন্ন্যাসীর জন্য যজ্ঞ করা বাধ্যতামূলক নয়। তাই সে সমস্ত যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান ত্যাগ করার দ্বারা তারা মনে করে যে তারা মুক্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কৃষ্ণভাবনামৃতের আদর্শ স্তরে না আসা পর্যন্ত মুক্তির কোন প্রশ্নই ওঠে না। পড়তে থাকো।

ভক্তঃ "কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা স্বার্থপরায়ণ, কারণ তাদের লক্ষ্য হচ্ছে নির্বিশেষ ব্রহ্মসাযুজ্য লাভ করা।"

শ্রীল প্রভুপাদঃ হ্যাঁ। চাহিদা রয়েছে। নির্বিশেষ ব্রহ্মবাদীদের একরকম চাহিদা রয়েছে, তা হচ্ছে নির্বিশেষ পরব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়া। কিন্তু ভক্তের কোনও চাওয়া-পাওয়া নেই। তিনি কেবল শ্রীকৃষ্ণের প্রীতিসাধনের উদ্দেশ্যে তাঁর সেবায় নিজেকে নিযুক্ত রাখেন। ভক্তেরা তার বিনিময়ে কিছুই চান না। সেটিই হচ্ছে শুদ্ধভক্তি। ঠিক যেমন ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন, ন ধনম্ ন জনম্ ন সুন্দরীম্ কবিতাম্ বা জগদীশ কাময়ে (শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত, অন্ত্যলীলা ২০.২৯, শিক্ষাষ্টক ৪) "আমি কোনও ধন-সম্পদ চাই না, কোনও অনুগামীও চাই না, আমি কোন সুন্দরী স্ত্রী-ও কামনা করি না। আমাকে কেবলমাত্র আপনার সেবাতেই যুক্ত থাকতে দিন।" ব্যাস। একে বলা হয় ভক্তিযোগের পন্থা। যখন ভগবান নৃসিংহদেব প্রহ্লাদ মহারাজকে বলেছিলেন, "আমার প্রিয় প্রহ্লাদ, তুমি আমার জন্য অনেক কষ্ট সহ্য করেছ, তাই তোমার যা ইচ্ছা আমার কাছে বর চাও।" তিনি এই বলে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। "হে প্রিয় প্রভু, আমি আপনার সঙ্গে কোনও ব্যবসা করছি না যে, আমার সেবার বিনিময়ে আমি আপনার কাছে কোনও পুরস্কার চাইব।" এটিই হচ্ছে শুদ্ধভক্তি। যোগী বা জ্ঞানীরা পরমতত্ত্বের সঙ্গে এক হয়ে যেতে চাইছে, পরমব্রহ্মের সঙ্গে কেন এক হতে হবে? কারণ তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে... এই জগতের দুঃখযন্ত্রণা থেকে। কিন্তু ভক্তের এসব কিছুই নেই। যদিও আপাতদৃষ্টিতে ভক্ত ভগবানের থেকে আলাদা হয়ে রয়েছে, তিনি সম্পূর্ণরূপে ভগবানের সেবার আনন্দে বিরাজ করেন। পড়তে থাকো।

ভক্তঃ এই সমস্ত বাসনা জাগতিক কামনা বাসনা থেকে মহত্তর হলেও তা স্বার্থশুন্য নয়। ঠিক তেমনই, যে যোগী অর্ধনিমীলিত নেত্রে, সব রকমের জাগতিক ক্রিয়াকলাপ পরিত্যাগ করে তপস্যা করে চলেছেন, তাও ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু যে ব্যক্তি...

শ্রীল প্রভুপাদঃ আসলে যোগীরা কিছু জড় শক্তি লাভের আকাঙ্ক্ষী, সেটিই তাদের যোগ অনুশীলনের সার্থকতা। ঠিক সার্থকতা নয়, বরং একটি পন্থা। ঠিক যেমন যদি আপনারা যোগের নিয়মকানুন সঠিকভাবে পালন করেন, তাহলে আট ধরণের সিদ্ধি লাভ করতে পারেন। আপনি তুলোর চেয়েও হালকা হয়ে যেতে পারেন, পর্বতের চেয়েও ভারী হতে পারেন। আপনার যা খুশী, আপনি তৎক্ষণাৎ তা পেতে পারেন। কখনও সখনও আপনি একটি গ্রহও তৈরি করে ফেলতে পারেন। এমনই সব শক্তিশালী যোগীরা রয়েছেন। যোগী বিশ্বামিত্র তা করেও ছিলেন। তিনি তাল গাছ থেকে মানুষ পেতে চেয়েছিলেন। "কেন মানুষের মাতৃগর্ভে দশ মাস অবস্থান করার পর জন্ম নিতে হবে?" ঠিক ফলের মতো তাদের উৎপন্ন করা হবে।" তিনি এমনটাই করেছিলেন। তাই যোগীরা কখনও কখনও এতোটা শক্তিশালীও হতে পারেন। তাঁরা এসব করতে পারেন। এসব কিছুই হল জাগতিক শক্তি। এতো শক্তিশালী যোগীরাও একদিন ধ্বংস হবেন। এই সব জাগতিক শক্তির দ্বারা আপনি কতদিন টিকে থাকতে পারবেন? তাই ভক্তিযোগীরা এই সব কিছুই চান না। পড়তে থাকো। হুম।

ভক্তঃ "কিন্তু কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত ভক্তই কেবল পরমেশ্বরের তৃপ্তিসাধন করার জন্য নিঃস্বার্থভাবে করেন। কৃষ্ণভাবনাময় ব্যক্তির মধ্যে একটুও আত্মতৃপ্তির বাসনা থাকে না। শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টিবিধান করাটাই তাঁর সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি। এবং তাই তিনিই হচ্ছেন যথার্থ সন্ন্যাসী বা যথার্থ যোগী। কৃষ্ণভাবনামৃতের মূর্তবিগ্রহ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রার্থনা করেছেন যে - "হে জগদীশ্বর! আমি ধন সম্পদ সংগ্রহের কোনও বাসনা করি না, আমি সুন্দরী স্ত্রীলোক উপভোগের বাসনাও করি না, আমি অনেক অনুগামীও কামনা করি না, আমার একমাত্র কামনা হচ্ছে আমি যেন জন্ম-জন্মান্তরে তোমার প্রতি অহৈতুকী ভক্তি লাভ করতে পারি।"

শ্রীল প্রভুপাদঃ একজন ভক্ত তাই এমনকি মুক্তির বাসনাও করেন না। ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কেন বললেন, 'জন্ম-জন্মান্তরে'? মুক্তিকামীরা, শুন্যবাদীরা এই জাগতিক জীবনের ইতি টানতে চায়, কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন, "জন্ম-জন্মান্তরে... " তার মানে হচ্ছে যে তিনি জন্মে জন্মে সব ধরণের জাগতিক দুঃখকষ্ট সহ্য করতেও প্রস্তুত। কিন্তু তিনি কি চাইছেন? তিনি কেবলমাত্র ভগবানের সেবায় নিযুক্ত থাকতে চান। সেটিই হচ্ছে যথার্থ সিদ্ধি। আমার মনে হয় তুমি এখানেই থামতে পারো। শেষ কর।