BN/Prabhupada 0642 - কৃষ্ণভাবনামৃতের অনুশীলন জড় দেহকে চিন্ময় দেহে রূপান্তরিত করে



Lecture on BG 6.1 -- Los Angeles, February 13, 1969

ভক্তঃ প্রভুপাদ? আপনি বলেছেন যে আত্মার আয়তন হচ্ছে একটি চুলের অগ্রভাগের দশ হাজার ভাগের একভাগ। চিন্ময় জগতেও কি আত্মার আয়তন তেমনটাই?

শ্রীল প্রভুপাদঃ হুম?

ভক্তঃ "চিন্ময় আত্মা যখন ফিরে যায়... "

শ্রীল প্রভুপাদঃ সেটিই আত্মার নিত্য স্বরূপ। এই জগতেই হোক আর চিন্ময় জগতেই হোক, তা একই। কিন্তু ঠিক যেমন এই জগতে তোমার জড় দেহটির বৃদ্ধি হচ্ছে, তেমনই চিন্ময় জগতেও তোমার চিন্ময় দেহের বৃদ্ধি হবে। বুঝলে? তোমার আসল স্বরূপ হচ্ছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণ। কিন্তু সেই ক্ষুদ্র কণ আত্মা বিস্তৃত হতে পারে। এই জড় জগতে সেই বৃদ্ধিটা জড়ের সংস্পর্শে ঘটে। আর চিন্ময় জগতে সেই একই বৃদ্ধি চিন্ময় বস্তুর সংস্পর্শে ঘটে। এই জড় জগতে আমি চিন্ময় আত্মা। আমি দেহ থেকে ভিন্ন কারণ আমার দেহটি জড় এবং আমি জীবন্ত সত্ত্বা। আমি জীবন্ত শক্তি। কিন্তু এই জড় দেহটি জীবন্ত শক্তি নয়। আর চিন্ময় জগতে সবকিছুই জীবন্ত শক্তি। সেখানে কোন জড় বস্তু নেই। তাই সেখানকার দেহটিও চিন্ময়। ঠিক যেমন জলের সাথে জল মিলে জলই হয়। কিন্তু জলের সাথে তেল মেশালে তা পৃথক হয়েই থাকে। ঠিক তেমনই, আমি চিন্ময় আত্মা। ধর, আমি হচ্ছি তেল, আমি এখন জলে রয়েছি, তার অর্থ হচ্ছে আমার সাথে পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু আমাকে যদি তেলে রাখা হয়, তাহলে সবকিছুই ঠিক থাকবে। নির্বিশেষবাদীদের কোনও দেহ থাকে না। তারা কেবলমাত্র ক্ষুদ্র কণ আত্মা রূপেই থেকে যায়। সেটিই হচ্ছে তাদের মতবাদ। কিন্তু আমরা বৈষ্ণবেরা ভগবানের সেবা করতে চাই। তাই আমাদের হাত, পা, মুখ, জিহ্বা এসব কিছুরই দরকার রয়েছে। তাই আমাদেরকে সেরকম দেহ দেয়া হয়। ঠিক যেমন মাতৃগর্ভ থেকে তুমি তোমার এই দেহটি লাভ করেছ, ঠিক তেমনই আমরা চিন্ময় জগতেও দেহ লাভ করি। মাতৃগর্ভ থেকে নয়। একটি নির্দিষ্ট পন্থায়।

ভক্তঃ সেটি কৃত্রিমভাবে করা যায় না। কেউই জাদু করে তা করতে পারে না।

শ্রীল প্রভুপাদঃ কৃত্রিমভাবে?

ভক্তঃ কেউই নিজের খামখেয়ালীবশে কোন চিন্ময় দেহ বানাতে পারে না, "ও, আমি চিন্ময় দেহ বানাবো। অভ্যাসের দ্বারা।"

শ্রীল প্রভুপাদঃ এই কৃষ্ণভাবনামৃত অভ্যাস-ই এই জড় দেহকে চিন্ময় দেহে রূপান্তরিত করে। তা কিভাবে হয়? আমি বেশ কয়েকবার এই উদাহরণটি দিয়েছি। যদি তুমি লোহাকে আগুনে ঢোকাও, এটি যতই উত্তপ্ত হতে থাকবে, ততই তা আগুনের মতো হয়ে যাবে। যখন সেই লোহাটি সম্পূর্ণ উত্তপ্ত হয়ে লাল হয়ে যায়, অর্থাৎ লোহাটি আগুনের মতো গুণ প্রাপ্ত হয়, সেই লোহাটিকে তুমি যেখানেই স্পর্শ করাবে, তা আগুনের মতোই কাজ করবে। ঠিক তেমনই এই দেহটি যদিও জড় ... এরকম অনেক উদাহরণ রয়েছে, একটি ধাতব বস্তু যখন বিদ্যুতায়িত করা হয়, ধাতব বস্তুটি বিদ্যুৎ নয়। কিন্তু যখন একে বিদ্যুতায়িত করা হয়, তখন যদি তুমি তা স্পর্শ কর, সঙ্গে সঙ্গে তুমি তড়িতাহত হবে। ঠিক যেমন বৈদ্যুতিক তার, তামার তার। এটি তামা। কিন্তু যেই মাত্র তাতে বিদ্যুৎপ্রবাহ করানো হবে, তা স্পর্শ করা মাত্রই তুমি বৈদ্যুতিক আঘাত পাবে। এরকম অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। ঠিক তেমনই, যদি তোমার এই দেহটি চিন্ময়ত্ব লাভ করে, তাহলে এতে আর কোনও জাগতিক প্রভাব থাকবে না। জাগতিক প্রভাব মানে ইন্দ্রিয় তৃপ্তি। যতই কেউ চিন্ময়ত্ব প্রাপ্ত হয়, ততই তার জাগতিক চাহিদা শুন্য হতে থাকে। আর কোনই জাগতিক কর্তব্য থাকে না। অতএব তুমি সেটি কিভাবে করতে পারো? সেই একই উদাহরণ। লোহাটিকে তোমাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে আগুনের সাথে লাগিয়ে রাখতে হবে। তোমার নিজেকে সর্বদাই কৃষ্ণভাবনাময় রাখতে হবে। তাহলে এমন কি তোমার এই জড় দেহটিও চিন্ময় হয়ে যাবে। সংস্কৃত ব্যাকরণে 'ময়' বলে একটি প্রত্যয় রয়েছে। 'ময়' মানে যেমন একটি শব্দ আছে, স্বর্ণময়। স্বর্ণময় মানে সোনালী। সোনালী মানে যখন কোন কিছু খাঁটি সোনা দিয়ে বানানো, তখন তাকেও সোনালী বলা হয়। আবার যদি তা অন্য কিছু দেয়ে বানানো কিন্তু অনেক পরিমাণ সোনার প্রলেপ দেয়া হয়, তাহলে তাকেও সোনালী বলা হয়। ঠিক তেমনই, এই জড় দেহটি যখন সম্পূর্ণভাবে চিন্ময় কার্যকলাপে যুক্ত থাকে তখন সেটিও চিন্ময়। তাই সন্ত-মহাত্মাদের, অবশ্য তোমাদের দেশে সবাইকেই মৃত্যুর পর মাটির নিচে সমাহিত করা হয়, কিন্তু ভারতে বৈদিক প্রথা অনুযায়ী, শুধুমাত্র অত্যন্ত মহান ব্যক্তি অর্থাৎ উন্নত মহাত্মাদের দেহ আগুনে পোড়ানো হয় না। তাদের দেহটি চিন্ময় বলে মানা হয়। সন্ন্যাসীর দেহ পোড়ানো হয় না, কারণ তা চিন্ময় বলে গণ্য করা হয়। এটি কিভাবে চিন্ময় হল? সেই একই দৃষ্টান্ত। যখন এই দেহটি আর কোনও জাগতিক কর্মে লিপ্ত নেই, কেবল চিন্ময় কৃষ্ণভাবনাময় কার্যকলাপ, সেই দেহটি তখন চিন্ময় হয়ে যায়। তাই যদি এই জগৎ কৃষ্ণভাবনামৃতে পূর্ণ হয়, কেউই আর নিজ ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য কাজ না করে কেবল শ্রীকৃষ্ণের ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য কর্ম করে, তাহলে তৎক্ষণাৎ এই জগৎ চিন্ময় জগতে পরিণত হবে। এটি বুঝতে কিছু সময় লাগবে। শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধানের যাই কিছু ব্যবহার করা হবে, কেবল কৃষ্ণপ্রীতির জন্য, তা-ই চিন্ময়। ঠিক যেমন আমরা কৃষ্ণকথা বলার জন্য এই মাইক্রোফোনটি ব্যবহার করছি, তাই এটি চিন্ময়। অন্যথায় এই প্রসাদ এবং সাধারণ খাবারের মধ্যে পার্থক্যটি কি? আমরা প্রসাদ বিতরণ করছি। লোকেরা জিজ্ঞেস করে, "এটি প্রসাদ হল কিভাবে? একই ফল তো আমরাও খাচ্ছি, আর আপনারা শুধু ফলটি কয়েকটি টুকরো করেছেন আর তা প্রসাদ হয়ে গেল?" তারা এটি বলতে পারে যে এটি কিভাবে প্রসাদ হল? কিন্তু এটিই প্রসাদ। তোমরা এই প্রসাদ গ্রহণ করতে থাকো, তাহলে এক সময় তোমরা চিন্ময় হয়ে যাবে। আসলে এটিই প্রসাদ। ঠিক যেমন সেই একই উদাহরণ, যদি আমি সেই প্রচণ্ড উত্তপ্ত সেই লাল লোহাটিকে বলি, "এটি আগুন" কেউ হয়তো বলতে পারে, "ওহ, এটি আগুন কেন হবে? এ তো লোহা।" আমি বলব, "এটি স্পর্শ কর"। বুঝতে পারছো? এইগুলি কিছু স্থুল উদাহরণ, কিন্তু সেটিই...

যখন তোমার কার্যকলাপ... প্রকৃতপক্ষে উন্নত বিচারধারায় জড় বলতে কিছুই নেই। জড় বলতে কিছু নেই, সবকিছুই চিন্ময়। কারণ শ্রীকৃষ্ণ চিন্ময়। শ্রীকৃষ্ণ হলেন পূর্ণ চেতন বা পরমাত্মা আর জড় বস্তু হল শ্রীকৃষ্ণের একটি শক্তি মাত্র। তাই এটিও চেতন। কিন্তু যেহেতু এটির অপব্যবহার হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে ব্যবহার হচ্ছে না, তাই এটি জড়। তাই আমাদের কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন হচ্ছে সবকিছুকেই পুনরায় চিন্ময়ত্ব দান করা। সম্পূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যে কোনও কিছু। এটি একটি চমৎকার আন্দোলন। তাই লোকেদের এটি বোঝা উচিৎ। আর যদি এটি প্রকৃত অর্থেই সারা বিশ্বকে চিন্ময় করে তুলতে পারে, অবশ্য তা সম্ভব নয়, কিন্তু আদর্শটি ঠিক তাই। কিন্তু কমপক্ষে যদি কেউ ব্যক্তিগতভাবেও এই পুনঃচিন্ময়ীকরণ পন্থাটি চেষ্টা করে, তাহলে তার জীবন সার্থক হয়ে উঠবে।